হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার মামলার বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে

image

ভারতে পালিয়ে যাওয়া ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এ মামলার বিচার হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। গতকাল বুধবার ছাত্র আন্দোলনে শহীদ শিক্ষার্থী আরিফ আহমেদ সিয়ামের পিতা বুলবুল কবির মামলার আবেদন জমা দেন। রাজধানীর ধানমন্ডিস্থ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অভিযোগটি তদন্তের জন্য আমলে নিয়েছে। এ তথ্য জানিয়েছেন বুলবুল কবিরের আইনজীবী গাজী এমএইচ তামিম।

সিয়াম সাভারে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। এ তথ্য জানিয়েছেন গাজী এম.এইচ. তামিম। তিনি জানান, শেখ হাসিনাসহ ১০ জনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থায় আবেদন করা হয়েছে। আবেদনে আরিফ আহমেদ সিয়াম ছাড়াও ১৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সংঘটিত হত্যা, গণহত্যা, নির্যাতনের তদন্ত এবং বিচার চাওয়া হয়েছে। এ সময়ে আহত হয়ে পরবর্তীতে বিভিন্ন তারিখে মৃত্যু বরণকারীদের বিষয়টিও তদন্তের অন্তর্ভুক্ত থাকবে। আবেদনে ঘটনাস্থল উল্লেখ করা হয়েছে ‘সমগ্র বাংলাদেশ’।

‘অপরাধের ধরন’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, ১ থেকে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্যান্য আসামিরা দেশীয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অপরাধ। শেখ হাসিনা ছাড়াও অভিযোগের অন্য আসামিরা হলেন, আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক ও পতিত সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, সাবেক ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, সাবেক তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী আরাফাত এবং তৎকালীন সরকারের কতিপয় মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী ও সংসদ সদস্য, সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, সাবেক অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিএমপির সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, কতিপয় অসাধু পুলিশ কর্মকর্তা ও সদস্য, র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ব্যারিস্টার মো: হারুন অর রশিদ ও কতিপয় অসাধু র‌্যাব কর্মকর্তা ও সদস্যসহ অজ্ঞাতনামা অস্ত্রধারী আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের নেতাকর্মী, সংগঠন হিসেবে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ ও অঙ্গ সংগঠনসমূহ।

অভিযোগে বলা হয়েছে ১ নম্বর আসামি (শেখ হাসিনা) থেকে শুরু করে ৯ নম্বর আসামির নির্দেশ ও পরিকল্পনায় অন্য আসামিরা দেশীয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। আন্দোলনকারীদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটন করেছেন।

অপরাধের ধরণের বলা হয়েছে, এক থেকে নয় নম্বর আসামির নির্দেশে ও পরিকল্পনায় অন্যান্য আসামিরা দেশীয় এবং আগ্নেয়াস্ত্র দ্বারা নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকারী সাধারণ নিরস্ত্র ছাত্র জনতাকে হত্যা করে তাদের সমূলে বা আংশিক নির্মূল করার উদ্দেশ্যে গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের অপরাধ।

আবেদনে অভিযোগটি কমপ্লেন্ট রেজিস্টারভুক্ত করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের বিধান অনুযায়ী আসামিদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলা হয়েছে। জানতে চাইলে তদন্ত সংস্থার উপ-পরিচালক (প্রশাসন) আতাউর রহমান বলেন, অভিযোগটি গ্রহণ করা হয়েছে। কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। অভিযোগ তদন্ত করা হবে।অ্যাডভোকেট গাজী এম এইচ তামিম বলেন, অভিযোগ–সংবলিত আবেদনটি বুধবার দুপুরে তদন্ত সংস্থায় দাখিল করা হয়েছে। আইনি প্রক্রিয়ায় তদন্ত সংস্থা এখন অভিযোগের তদন্ত করে ট্রাইব্যুনালের চীফ প্রসিকিউটরের কাছে জমা দেবেন। চীফ প্রসিকিউর আনুষ্ঠানিক অভিযোগ আকারে তা ট্রাইব্যুনালে দাখিল করবেন। এর আগে তদন্ত চলাকালে তদন্ত কর্মকর্তা চীফ প্রসিকিউটরের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেফতারি পরোয়ানার জন্য ট্রাইব্যুনালে আবেদন করতে পারেন। তখনই এটি ট্রাইব্যুালের মামলা হিসেবে লিপিবদ্ধ হবে।

উল্লেখ করা যেতে পারে, গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভুত অভ্যুত্থানে উৎখাত হওয়া আওয়ামীলীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতার মসনদে আরোহন করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ১৯৭৩ সালের আইনে সংশোধনী এনে গঠন করা হয় ট্রাইব্যুনাল। সংশোধনীতে ট্রাইব্যুনালে ব্যক্তি এবং গোষ্ঠিকেও বিচারের আওতায় আনার বিধান যুক্ত করা সহ বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংশোধনী আনা হয়। সংশোধিত আইনের ভিত্তিতে ২০১০ সালের ২৫ মার্চ যাত্রা শুরু করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের লক্ষ্যে ট্রাইব্যুনাল করা হয়েছে-মর্মে দাবি করা হলেও ট্রাইব্যুনালের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দেশে-বিদেশে প্রশ্ন ওঠে। বিশেষত: স্কাইপ কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর টাইব্যুনাল নিয়ে শুরু হয় তুমুল বিতর্ক। শেখ হাসিনার দেড় দশকের শাসনামলে ট্রাইব্যুনালকে ব্যবহার করা হয় ভারতের প্রেসিক্রিপশনে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নেতৃত্ব শূন্য করার মিশনে। এতে ‘বিচার’ পরিণত হয় প্রহসনে। পতিত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার শাসনামলে এই ট্রাইব্যুনালের ‘রায়’র ভিত্তিতে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতে ইসলামীর তৎকালিন আমীর মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, আব্দুল কাদের মোল্লা, মোহাম্মদ কামারুজ্জামানসহ জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ স্থানীয় নেতাদের মৃত্যুদন্ড দেয়া হয়। আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীকে আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়।

বিচারকদের সম্পদ বিবরণী দাখিলের নির্দেশ :
এর আগে গতকাল বুধবার সকাল ১১টায় অন্তর্বর্তীকালিন সরকারের আইন বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড.আসিফ নজরুল শেখ হাসিনা এবং গণহত্যায় জড়িতদের বিচার ১৯৭৩ সালের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনে হবে-মর্মে জানান। মন্ত্রণালয়ের কনফারেন্স লাউঞ্জে অনুষ্ঠিত এক ব্রিফিংয়ে তিনি এ তথ্য জানান। এর পরপরই দায়ের করা হয় উপরোক্ত অভিযোগ।

ব্রিফিংয়ে তিনি জানান, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে ‘গণহত্যার’ বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে করার উদ্যোগ নেবে অন্তর্বর্তীকালিন সরকার। ড. আসিফ নজরুল বলেন, বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটাও খতিয়ে দেখবো।

আইন, বিচার ও সংস বিষয়ক এ উপদেষ্টা বলেন, গণহত্যা এবং গুলিবর্ষণ এসব ঘটনার জন্য সারা দেশে কিছু মামলা হয়েছে। রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি করেছেন এটাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে বিচার করার স্কোপ আছে কিনা। আমরা সেটা খতিয়ে দেখেছি। রাষ্ট্রের পাশাপাশি যে কোনো ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিও নিজ উদ্যোগে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চেয়ে তদন্ত সংস্থার কাছে আবেদন জানাতে পারেন।

আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় ইতোমধ্যে বেশ কিছু মামলা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘রাজপথে থাকা বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন, জনগণের বিভিন্ন গোষ্ঠী দাবি করেছেন এটাকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিচার করা যায় কিনা। আমরা সেটি খতিয়ে দেখেছি। আমরা জানাতে চাই, আমাদের ১৯৭৩ সালের যে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইম টাইব্যুনাল অ্যাক্ট আছে; যা পরে ২০০৯ এবং ২০১৩ সালে সংশোধনী হয়েছে, সেই আইনে জুলাই গণহত্যা; এই গণহত্যা বলতে আগস্ট মাসের প্রথম পাঁচ দিনের গণহত্যাকেও বোঝাচ্ছি, এই গণহত্যার বিচার সম্ভব। এর জন্য দায়ী যে ব্যক্তিরা আছেন, তাদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের জন্য আমরা ইতিমধ্যে ছোটখাটো একটা গবেষণা করেছি। তাতে দেখেছি, এই আইনের অধীনে জড়িতদের; অর্থাৎ যারা আদেশ দিয়েছেন, বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন, তাদের সকলকে বিচারের আওতায় আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, আপনারা জানেন এই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে একটি ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি আছে, প্রসিকিউশন টিম আছে। এগুলোকে আমরা রি-অর্গানাইজ করার চেষ্টা করছি।

এই তদন্ত জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে করার চেষ্টা চলছে। জাতিসংঘ থেকে আমাদের বারবার সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে। আমরা বিচারে সত্যিকারের স্বচ্ছতা-নিরপেক্ষতা নিশ্চিত করার জন্য আমাদের ইনভেস্টিগেশন টিম জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে কাজ করবে। তদন্ত জাতিসংঘের ‘সর্বাত্মক তত্ত্বাবধানে’ করার উদ্যোগ নেয়া হবে মর্মেও জানান তিনি। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা জানান, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার চলাকালে অভিযুক্ত ব্যক্তিরা কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে-এমন যে কোনো দেশ থেকে আইনজীবী নিয়োগ দিতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিদেশী আইনজীবীদের ওয়েলকাম করা হবে। এবং এ বিচার প্রক্রিয়া থাকবে দেশী-বিদেশী সংবাদকর্মী-পর্যবেক্ষকদের জন্য উন্মুক্ত।

ঢাকায় জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠক করার সিদ্ধান্ত হয়েছে উল্লেখ করেন আইন উপদেষ্টা বলেন, আমরা তার কাছে সহযোগিতা চাইবো। এছাড়া জাতিসংঘের বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে কনসার্ন এজেন্সির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হবে। আমরা আশা করছি, শিগগিরই এটা শুরু করতে পারবো। সে ক্ষেত্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সুনির্দিষ্টভাবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে ওইসব ঘটনার বিচারের উদ্যোগ নিচ্ছে কিনা জানতে চাওয়া হলে উপদেষ্টা বলেন, আইসিটিতে বিচারের উদ্যোগ নেয়া হবে, এটা ক্যাটাগরিক্যালি বলতে পারেন।

ড.আসিফ নজরুল বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, সাবেক সরকারের সরকারপ্রধানসহ অন্য যারা জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে, যাদের আদেশ নির্দেশ থাকার অভিযোগ রয়েছে, আমরা পত্রপত্রিকায় কিছু মন্ত্রীর নাম দেখেছি। আমরা এখানে কোনও ছাড় দেবো না। আমরা বিদায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যদেরও যদি কমান্ড রেসপনসিবিলিটি থাকে, আমরা সেটাও খতিয়ে দেখবো।

এদিকে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না এবং সাংবাদিক রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া মামলা (১৯২৩ সালের অসিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ও দন্ডবিধির দুটি ধারার মামলা) প্রত্যাহার করা হয়েছে বলে জানান ড. আসিফ নজরুল। প্রতিনিধিত্বমূলক উদাহরণ হিসেবে এই দুই মামলার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, মন্ত্রণালয় রাত-দিন কাজ করছে। এমন আরও অনেক মামলা প্রত্যাহার করা হবে। আমরা অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কাজ করছি। আশা করছি আগামি বৃহস্পতিবারের মধ্যে আন্দোলনকারীদের ওপর ঢাকায় দায়ের হওয়া সমস্ত মামলা প্রত্যাহার হবে।

ব্রিফিংয়ে ড. আসিফ নজরুল আগামি ১০ দিনের মধ্যে জুডিশিয়াল সার্ভিসের সকল কর্মকর্তার দেশে-বিদেশে স্থাবর-অস্থাবর সম্পদের হিসেব দাখিল করতে হবে বলেও জানান।
হাসিনার বিরুদ্ধে ছাত্র হত্যার মামলা : রাজধানীর কাফরুলে ঢাকা মডেল ডিগ্রি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থী ফয়জুল ইসলাম রাজনের (১৮) গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনায় শেখ হাসিনাসহ ২৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। গতকাল ঢাকার আদালতে এ অভিযোগ করেন নিহত রাজনের ভাই রাজিব (৩২)। মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আহম্মেদ হুমায়ুন কবির বাদীর জবানবন্দি গ্রহণ করে কাফরুল থানাকে অভিযোগটি এজাহার হিসেবে গ্রহণের নির্দেশ দেন।

মামলার অপর আসামিরা হলেন, সাবেক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, বস্ত্র ও পাট মন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাসান মাহমুদ, তথ্য প্রতিমন্ত্রী মোহাম্মদ এ আরাফাত, বেসরকারি শিল্প বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, আওয়ামীলীগের সাবেক এমপি মইনুল হোসেন খান নিখিল, ঢাকা উত্তরের আ’লীগের সাধারণ সম্পাদক এম এ মান্নান কচি, স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গাজী মেজবাউল হক সাচ্ছু, এমপি কামাল আহম্মেদ মজুমদার, আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, র‌্যাব মহাপরিচালক হারুন অর রশিদ, ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, ডিবি প্রধান হারুন আর রশিদ, যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, স্থানীয় আ’লীগের ওয়ার্ড সভাপতি মোফাজ্জল হোসেন, উত্তর সিটি করপোরেশনে কাউন্সিলর জামাল মোস্তফা, ছাত্রলীগের সভাপতি সাদ্দাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদ ওয়ালী আসিফ ইনান, ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রলীগ নেতা সালামত উল্লাহ সাগর ও সদস্য দীপংকর বাছার দীপ্ত। এ ছাড়াও আওয়ামী লীগের আরও ৫ থেকে ৬শ’ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।

বাদী অভিযোগ করে বলেন, রাজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ব্যানারে আন্দোলনে শরিক হন। এ গণ-আন্দোলনকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে শেখ হাসিনা ওয়াজেদ গত ১৪ জুলাই গণভবনে অনুষ্ঠিত প্রেস কনফারেন্সে আন্দোলনকারী ছাত্রদের ‘রাজাকরের বাচ্চা’ বলে অভিহিত করেন। ওবায়দুল কাদের গত ১৫ জুলাই ‘আন্দোলনকারীদের মোকাবিলা করার জন্য ছাত্রলীগই যথেষ্ট’ মর্মে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়। আসাদুজ্জামান খান কামাল, আনিসুল হক, হাসান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, মাইনুল হোসেন খান নিখিল, শেখ ফজলে শামস পরশ, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, খসরু চৌধুরীদের পরিকল্পনা ও প্রত্যক্ষ নির্দেশনায় আন্দোলনকারীদের নিষ্ঠুরভাবে দমনের লক্ষ্যে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলনরত নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের দেখামাত্র গুলি করে হত্যার নির্দেশ দেন।’ ১৯ জুলাই হত্যার উদ্দেশ্যে নির্বিচারে গুলি চালালে আমার ভাই ফয়জুল ইসলাম রাজন মিরপুর-১০ গোলচত্বর বুকে গুলিবিদ্ধ হয়। এদিন ফয়জুল ইসলাম রাজন ছাড়াও আরও অনেক ছাত্র গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত এবং নিহত হন।

এদিকে গত ২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্টের এক আইনজীবীকে গুমের নামে অপহরণ ও নির্যাতনের অভিযোগে শেখ হাসিনাসহ ৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। অন্যরা হলেন, সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক এবং র‌্যাবের সাবেক মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ। সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী সোহেল রানা ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট ফারজানা শাকিল সুমু চৌধুরীর আদালতে এই মামলা করেন।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে যাওয়া শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে ঢাকায় এটি দ্বিতীয় মামলা। শুনানির পর ম্যাজিস্ট্রেট অভিযোগকারীর বক্তব্য রেকর্ড করেন এবং উত্তরা পশ্চিম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে অভিযোগটি নথিভুক্ত করার নির্দেশ দেন।

এর আগে মোহাম্মদপুর এলাকার মুদি দোকানি আবু সায়েদ নিহত হওয়ার ঘটনায় গত মঙ্গলবার শেখ হাসিনাসহ সাতজনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ মামলা হিসেবে গ্রহণ করার নির্দেশ দেন ঢাকার চীফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতের ম্যাজিস্ট্রেট রাজেশ চৌধুরী। মোহাম্মদপুর থানা আবেদনটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে গতকাল আদালতে পাঠায়। আদালত মামলার পরবর্তী তারিখ ধার্য রেখেছেন আগামি ১৫ সেপ্টেম্বর।

বিএনপি অফিসে অভিযান : পুলিশের বিরুদ্ধে ২ মামলা : অপরদিকে দুই বছর আগে নয়া পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে ‘পুলিশি অভিযানের নামে লুটপাট ও ডাকাতির’ অভিযোগে সাবেক পুলিশ মহাপরিদর্শক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন ও ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদসহ ৩০ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে পল্টন মডেল থানায় দুটি অভিযোগ দায়ের করেছে বিএনপি। দলটির ‘মামলা তথ্য ও সংরক্ষণ’ বিষয়ক কর্মকর্তা সালাহ উদ্দীন খান গতকাল বুধবার সকালে পল্টন মডেল থানায় অভিযোগ দুটি দায়ের করেন। থানার ওসি সেন্টু মিয়া অভিযোগগুলো গ্রহণ করেন।

সালাহ উদ্দীন খান পরে সাংবাদিকদের বলেন, “আপনারা জানেন, ২০০৯ সাল থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত পুলিশ অফিসারা অনেক মিথ্যা মামলা দিয়েছে, হয়রানি করেছেন, আমাদেরকে গুম করেছে। সর্বশেষ ২০২২ সালের একটি ঘটনা নিয়ে এসেছি। হারুন অর রশীদ, মেহেদী হাসান, বিপ্লব কুমার সরকার– এরা আমাদের অফিসের দরজা ভেঙে ভেতরে প্রবেশ করে আমাদের অফিসের সব মালামাল নিয়ে যায়। প্রায় ৪৭ লক্ষ টাকার মালামাল ডাকাতি করেছে। আর তিন লক্ষ ৫০ টাকার মালামাল নষ্ট করেছে। সেই সংক্রান্ত একটা মামলার অভিযোগ আজকে আমরা এখানে এফআইআর জমা দিয়েছি।

“দ্বিতীয়টা ১৬ জুলাই। সেদিন ডিবির হারুন অর রশীদ, ডিএমপির মেহেদী হাসান, বিপ্লব কুমার সরকার– এরা অস্ত্র তৈরি করার হাতিয়ারসহ বিভিন্ন অবৈধ অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে আমাদের কার্যালয়ে দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী আহমেদ স্যারের রক্ষে রাখে, তৃতীয় তলায় অবৈধ বোম রাখে। একটা নাটক সাজিয়ে তারা বিভিন্ন জিনিসপত্র চুরি করে নিয়ে যায়। এই যে তারা(পুলিশ কর্মকর্তারা) অবৈধ অস্ত্র, গোলা বারুদ, বোম রাখল, কার্যালয়ের বাইরে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ভয়ভীতি দেখাল, তার একটি অভিযোগ নিয়ে আমরা এসেছি। আমরা ডিউটি অফিসার এসআই মিজানুর রহমানের সাথে কথা বলেছি। পরে ওসি সেন্টু মিয়া অভিযোগগুলো গ্রহণ করেছেন। মামলা নম্বর ১ ও ২।